এম মনির চৌধুরী রানা : চট্টগ্রামের কালুরঘাট সেতুতে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। যে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল মা-বাবার কোলে থাকা দুই বছরের এক শিশুসহ দুজনের।
পবিত্র ঈদুল আজহার দুদিন আগে গত ৫ জুন রাতে চট্টগ্রামের কালুরঘাট সেতুর পূর্ব প্রান্তে এই দুর্ঘটনা ঘটে। এই দুর্ঘটনার জন্য কক্সবাজার থেকে ছেড়ে আসা পর্যটক এক্সপ্রেসের ট্রেনচালক গোলাম রসুল ও সহকারী ট্রেনচালক মোহাম্মদ আমিন উল্লাহকে দায়ী করেছে রেলওয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি।
তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তির সুপারিশ করেছে কমিটি। দুর্ঘটনার পরপরই এই দুই চালকসহ চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত করেছিল রেলওয়ে। তবে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া ট্রেনের গার্ড সোহেল রানা ও অস্থায়ী গেটকিপার মো. মাহবুবের দায় খুঁজে পায়নি কমিটি। রেলের তদন্ত কমিটি বৃহস্পতিবার ১৯ জুন বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (চট্টগ্রাম) এ বি এম কামরুজ্জামানের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।
তিনি প্রতিবেদন পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ৫ জুন রাতে এই সেতুর পূর্ব প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা চারটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা, দুটি মোটরসাইকেল ও একটি আইসক্রিমবাহী ভ্যানকে ধাক্কা দিয়ে চুরমার করে দেয় কক্সবাজার থেকে ছেড়ে আসা পর্যটক এক্সপ্রেস।
এতে অটোরিকশাচালক তৌহিদুল ইসলাম ওরফে তুষার (২৯) এবং দুই বছরের শিশু মেহেরিমা নূরের মৃত্যু হয়। আহত হয়েছেন অন্তত ১৬ জন। শিশু মেহেরিমা মা-বাবার সঙ্গে তৌহিদুল ইসলামের অটোরিকশার যাত্রী ছিল। মেয়ের নিথর দেহ নিয়ে বাবা সাজ্জাদুন নূরের আহাজারির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এই দুর্ঘটনা নিয়ে মানুষের মাঝে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এই দুর্ঘটনায় সাজ্জাদুন নূরের স্ত্রী জুবাইরা ইসরাও আহত হয়েছেন। ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি বোয়ালখালীতে যাচ্ছিলেন সাজ্জাদুন।
রেলওয়ের বিভাগীয় ব্যবস্থাপক এ বি এম কামরুজ্জামান আজ বলেন, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন হাতে পেয়েছেন। কমিটির সদস্যরা দুর্ঘটনার জন্য কারা দায়ী, কী কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং দুর্ঘটনা এড়াতে বিভিন্ন সুপারিশ দিয়েছেন। এই প্রতিবেদন পর্যবেক্ষণ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন তাঁরা। তবে তিনি প্রতিবেদনের বিস্তারিত জানাতে রাজি হননি।
রেলওয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই দুর্ঘটনার জন্য ট্রেনচালক ও সহকারী ট্রেনচালকের দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। কেননা সেতুতে ওঠার আগে ডেড স্টপ রয়েছে। প্রথমে ট্রেন ওখানে এসে দাঁড়ানোর কথা। সেখানে নির্ধারিত বইয়ে সই করবেন। এরপর সংকেত মেনে সেতুতে উঠবেন। তখন ট্রেনের গতি থাকবে ১০ কিলোমিটার। কালুরঘাট সেতুর দুই প্রান্তেই ডেড স্টপ রয়েছে। কিন্তু ট্রেনচালক ডেড স্টপে এসে দাঁড়াননি।
গেটকিপারের সংকেতও উপেক্ষা করেছেন। উল্টো ট্রেন চালিয়েছেন ২৬ থেকে ২৭ কিলোমিটার গতিতে। ট্রেনচালক যদি গেটকিপারের সংকেত দেখে ডেড স্টপে থামতেন, তাহলে ওই সময়ের মধ্যে সেতুতে চলাচলরত গাড়িগুলো সহজে পার হতে পারত। এতে দুর্ঘটনা এড়ানো যেত।
দুর্ঘটনা এড়াতে সুপারিশ : চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটসহ বিভিন্ন লাইনে ট্রেন দুর্ঘটনা এড়াতে তদন্ত প্রতিবেদনে ১০টির বেশি সুপারিশ করেছে কমিটি। এর মধ্যে কালুরঘাট সেতু এলাকায় যাতে দুর্ঘটনা না ঘটে, সে জন্য কয়েকটি সুপারিশ করেছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কালুরঘাট সেতুর দুই প্রান্তে দায়িত্বরত গেটকিপারদের ওয়াকিটকি দেওয়া।
এ ছাড়া ট্রেনচালক ও গার্ডদেরও ওয়াকিটকি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। কেননা দায়িত্বরতদের হাতে মুঠোফোন থাকলেও মাঝেমধ্যে নেটওয়ার্কের সমস্যা থাকে। এতে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন থাকার শঙ্কা সৃষ্টি হয়। ওয়াকিটকি থাকলে এই সমস্যা থাকবে না।
এ ছাড়া সেতুর দুই প্রান্তে স্থায়ী ও অভিজ্ঞ গেটকিপারদের দায়িত্ব দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। আর সেতুর দুই পাশে বিদ্যমান গেট প্রতিবন্ধকের পাশাপাশি আরও দুটি গেট প্রতিবন্ধক স্থাপন করতে হবে। দুর্ঘটনার ঝুঁকি জানাতে এবং সংকেত মানার বিষয়ে উৎসাহিত করতে সেতুর দুই প্রান্তের প্রবেশমুখে দুর্ঘটনার কারণসংবলিত বোর্ড স্থাপন করা দরকার।
তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দেখে, স্থানীয় মোটরসাইকেলচালকেরা গেটের সংকেত মানেন না। তাঁরা ট্রেন সেতুর ওপর থাকতেই মোটরসাইকেল নিয়ে সেতুতে উঠে যান, যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি করে। এ জন্য স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে কমটি গঠন করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। কমিটির সদস্যরা স্থানীয় চালকদের আইন মানতে বাধ্য করার প্রয়োজনীয়তা উপস্থাপন করবেন।
এদিকে, তদন্ত প্রতিবেদনে বিভাগীয় কর্মকর্তা এবং তাঁদের অধীনে থাকা সব কর্মকর্তাকে নিয়মিত পরিদর্শন এবং রেজিস্টারে মতামত প্রতিবেদন লেখার সুপারিশ করেছে কমিটি। আর বোয়ালখালীর গোমদণ্ডী ও নগরের জানআলীহাট স্টেশন থেকে ট্রেন অতিক্রম করার সময় নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে ট্রেনচালক ও গার্ডদের ডেড স্টপ এবং সেতুর গতিনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে অবহিত করতে হবে।